মিষ্টিকুমড়ার জাত : আমাদের দেশে বিভিন্ন ধরনের মিষ্টিকুমড়ার জাত রয়েছে । যেমন - সুপ্রিমা , সুইটি , ড্রিমগার্ল্ড ইত্যাদি হাইব্রিড জাতের মিষ্টিকুমড়া । এর মধ্যে সুইটি জাতের মিষ্টিকুমড়া বেশি ওজনের হয়ে থাকে । বারি মিষ্টিকুমড়া -২ ও বারি হাইব্রিড মিষ্টিকুমড়া -১ আধুনিক জাত ।
মিষ্টিকুমড়ার উৎপাদনে মাটির গুণাগুণ : আমাদের দেশে প্রায় সব ধরনের মাটিতে মিষ্টিকুমড়ার চাষ করা যায় । তবে । চরাঞ্চলের পলি মাটিতে মিষ্টিকুমড়ার ফলন খুব ভাল হয় । এছাড়াও বেলে দোঁ - আশ বা এঁটেল দোঁ - আশ মাটিতে চাষ করা যায় ।
মিষ্টিকুমড়ার উৎপাদনে সময় : গ্রীষ্মকালীন ফসলের জন্য ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত বীজ বােনার উপযুক্ত সময় ।
মিষ্টিকুমড়ার উৎপাদনে বীজবপন : মিষ্টিকুমড়ার বীজ মাটিতে মাদায় তৈরি করে বা পলিথিনে রােপন করা যায় । এজন্য প্রথমে অর্ধেক মাটি ও অর্ধেক গােবর একসঙ্গে ভাল করে মিশিয়ে বীজতলার জন্য মাটি তৈরি করতে হবে । মাটিতে বীজ গজানাের জন্য “ জো ” নিশ্চিত করে তা পলিব্যাগে ভরতে হবে । অতঃপর প্রতি ব্যাগে দুইটি করে বীজবপন করতে হবে । বীজ এক হতে দেড় ইঞ্চি মাটির গভীরে পুঁতে দিতে হবে । এছাড়া প্রত্যেক মাদায় ৩-৪ টি বীজবপন করতে হবে । মিষ্টিকুমড়া চাষের জন্য প্রতি শতাংশে ২.৫ গ্রাম বীজের প্রয়ােজন হতে পারে ।
মিষ্টিকুমড়ার উৎপাদনে সারের মাত্রা ও প্রয়ােগ পদ্ধতি : ( প্রতি শতকে ৬ টি মাদা হিসেবে )
মিষ্টিকুমড়ার উৎপাদনে চারারােপন ও পরিচর্যা :
> মিষ্টিকুমড়ার চারার বয়স ১৫-১৬ দিন হলে রােপন করা যায় । আর পলিব্যাগের চারা পলির ভাঁজ বরাবর ব্লেড দিয়ে কেটে পলিব্যাগ সরিয়ে মাটির দলাসহ চারাটি নির্দিষ্ট জায়গায় বসিয়ে চারপাশে মাটি দিয়ে ভরাট করতে হবে ।
পরিচর্যাঃ
> চারা রােপনের পর গর্তে পানি দিতে হবে ।
> মালচিং : প্রত্যেক সেচের পর হালকা মালচ করে গাছের গােড়ার মাটির চটা ভেঙ্গে দিতে হবে। > আগাছা দমন : আগাছা অনেক রােগের আবাস স্থল । এছাড়া আগাছা খাদ্যোপাদান ও রস শােষণ করে নেয় । কাজেই চারা লাগানাে থেকে শুরু করে ফল সংগ্রহ পর্যন্ত জমি সবসময়ই আগাছা মুক্ত রাখতে হবে ।
> সার উপরি প্রয়ােগ : চারা রােপণের পর মাদা প্রতি সারের উপরি প্রয়ােগের যে মাত্রায় উল্লেখ করা আছে তা গাছের গােড়ার কাছাকাছি প্রয়ােগ করতে হবে ।
> গাছের গােড়ার দিকে ৪০-৪৫ পর্যন্ত শােষক শাখাগুলাে ( ডালপালা ) ধারালাে ব্লেড দিয়ে কেটে অপসারণ করতে হবে ।
> পরাগায়ন প্রধাণতঃ মৌমাছির দ্বারা সম্পন্ন হয় । প্রাকৃতিক পরাগায়নের মাধ্যমে বেশি ফল ধরার জন্য হেক্টর প্রতি ২ - ৩ টি মৌমাছির কলােনী স্থাপন করা যেতে পারে । হাত দিয়ে কৃত্রিম পরাগায়ন করেও ফলন বৃদ্ধি করা সম্ভব ।
মিষ্টিকুমড়ার ক্ষতিকর পোকামাকড় ও রােগবালাই ব্যবস্থাপনা :
মিষ্টিকুমড়ার মাছিপােকার ক্ষতির ধরণঃ
> এই পােকা মিষ্টিকুমড়ার কচিফল ও ফুলের মধ্যে প্রথমে ডিম পাড়ে ।
> পরবর্তীতে ডিম থেকে কীড়া বের হয়ে ফল ও ফুলের ভিতর কুরে কুরে খায় যার ফলে ফল ও ফুল পচন ধরে নষ্ট হয়ে যায় ।
সমন্বিত ব্যবস্থাপনাঃ
> আক্রান্ত ফল সংগ্রহ করে তা নষ্ট করে ফেলতে হবে ।
> পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ ।
> সেক্স ফেরােমন ফাঁদের ব্যবহার ।
> মাছি পােকা দমনের জন্য বিষ ফাঁদ ব্যবহার করা । ( ঢাকনাসহ স্বচ্ছ প্লাষ্টিক পাত্রে জানালা কেটে বা ছােট মাটির পাত্রে ১০০ গ্রাম থেতলানাে মিষ্টিকুমড়া কিছু পানিসহ বা চিটাগুড় এর সাথে ০.৫ গ্রাম ডিপটেরেক্স ৮০ এসপি বা ১৫ ফোটা যে কোন বালাইনাশক ব্যবহার করা )।
> ২ মিলি সবিক্রণ / সাইপারমেথ্রিন ১ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করা ।
রেড পামকিন বিটল পােকার ক্ষতির ধরণঃ
> পামকিন বিটলের পূর্ণবয়স্ক পােকা চারা গাছের পাতায় ফুটো করে এবং পাতার কিনারা থেকে খাওয়া শুরু করে সম্পূর্ণ পাতা খেয়ে ফেলে ।
> এ পােকা ফুল ও কচি ফলেও আক্রমণ করে ।
সমন্বিত ব্যবস্থাপনাঃ
> চারা আক্রান্ত হলে হাত দিয়ে পূর্ণবয়স্ক পােকা ধরে মেরে ফেলা ।
> ক্ষেত সব সময় পরিষ্কার রাখতে হবে ।
> প্রতি লিটার পানিতে ডেনিটল / ট্রিবন -১ মিলি বা সুমিথিয়ন ২ মিলি বা সেভিন ২ গ্রাম স্প্রে করতে হবে ।
মিষ্টিকুমড়ার লাল ক্ষুদ্ৰমাকড়ের ক্ষতির ধরণঃ
> ছােট মাকড় পাতার নিচে থাকে এবং পাতার সবুজ অংশ খেয়ে ফেলে যার ফলে পাতা কুঁকড়িয়ে যায় । পরে পাতাটি হলুদ হয়ে মরে যায় ।
সমন্বিত ব্যবস্থাপনাঃ
> ক্ষেত পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখা ।
> প্রথমে আক্রান্ত পাতা নষ্ট করা ।
> জৈব বালাইনাশক ( বাইকাও ) ব্যবহার করতে হবে ।
> প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম রনভিট / থিওভিট বা কুমুলাস স্প্রে করতে হবে ।
জাবপোকার ক্ষতির ধরণঃ
> জাবপােকার আক্রমণে মিষ্টিকুমড়ার বাড়ন্ত ডগা ও পাতা হলুদ হয়ে যায় । গাছ তার সতেজতা হারিয়ে ফেলে এবং ফলন কমে যায় ।
> প্রাপ্ত ও অপ্রাপ্তবয়স্ক জাবপােকা দলবদ্ধভাবে গাছের পাতার রস চুষে খায় । ফলে পাতা বিকৃত হয়ে যায় , বৃদ্ধি ব্যাহত হয় ও প্রায়শ নিচের দিকে কোঁকড়ানাে দেখা যায় ।
সমন্বিত ব্যবস্থাপনাঃ
> ক্ষেত পরিষ্কার রাখতে হবে ।
> হলুদ রঙের ফাঁদ ব্যবহার করতে হবে ।
> প্রাথমিক অবস্থায় আক্রান্ত পাতা ও ডগার জাবপােকা হাত দিয়ে পিষে মেরে ফেলা যায় ।
> নিমবীজের দ্রবণ বা সাবানগােলা পানি স্প্রে করে এ পােকার আক্রমণ অনেকাংশে কমে যায়। > তামাকের গুড়া ( ১০ গ্রাম ) , সাবানের গুড়া ( ৫ গ্রাম ) ও নিমের পাতার নির্যাস প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ব্যবহার করা ।
> জৈব বালাইনাশক বাইকাও ২ মিলি/লিঃ পানি ব্যবহার করা ।
> আক্রমণ বেশি হলে প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলি সানগর , ২ মিলি ডায়াজিনন মিশিয়ে স্প্রে করা ।
সাদা গুঁড়া রােগ বা পাউডারি মিলডিউ রােগের লক্ষণঃ
> রােগের প্রারম্ভে গাছের নিচের বয়স্ক পাতায় রােগের লক্ষণ প্রকাশ পায় । ক্রমশঃ উপরের পাতায় রােগ ছড়িয়ে পড়ে ।
> প্রথমে পাতার উপর বিক্ষিপ্ত সাদা সাদা দাগের সৃষ্টি হয় ।
> রােগ বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে দাগ আকারে বড় হতে থাকে এবং হলুদ বর্ণ থেকে বাদামী রঙ ধারণ করে ।
> রােগের প্রকোপ বেশি হলে গাছের লতা ও কান্ড আক্রান্ত হয় ।
> ধীরে ধীরে সেই লতা ও পরে পুরাে গাছই মরে যেতে পারে ।
সমন্বিত ব্যবস্থাপনাঃ
> রােগ নিয়ন্ত্রণের জন্য আগাছা বিনাশ করতে হবে ।
> জমির আশে - পাশে কুমড়া জাতীয় যে কোন সবজি চাষ থেকে বিরত থাক ।
> আগাম চাষ করে রােগের প্রকোপ কমানো যায় ।
> প্রতি ১০ লিটার পানিতে ২০ গ্রাম ইনসাফ / সিউভিট/কুমুলাস অথবা ১০ গ্রাম ক্যালিক্সিন ১৫ দিন পর পর স্প্রে করুন ।
> টিন্ট ২৫০ ইসি ০.৫ মিলি অথবা রনভিট -২ গ্রাম / প্রতি লিটার পানি মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
ডাউনি মিলডিউ রােগের লক্ষণঃ
> এই রােগ শুধু পাতায় হয় । আক্রান্ত পাতায় নানা আকারের দাগ পড়ে । সাধারণত দাগগুলি কোণাকৃতি ও হলদে হয় ।
> দাগগুলি খুব তাড়াতাড়ি সংখ্যায় বৃদ্ধি পায় ও আকারে বড়াে হয় । পাতার নিচের দিকে দাগের উপরে বেগুনি রংয়ের ছত্রাক জন্মে ।
সমন্বিত ব্যবস্থাপনাঃ
> রােগ নিয়ন্ত্রণের জন্য আগাছা বিনাশ করতে হবে ।
> জমির আশেপাশে কুমড়া জাতীয় যে কোনাে সবজি চাষ থেকে বিরত থাকা ।
> আগাম চাষ করে রােগের প্রকোপ কমানাে যায় ।
> আক্রান্ত গাছের পরিত্যক্ত অংশ সগ্রহ করে নষ্ট করতে হবে।
> ১-২ গ্রাম সিকিউর বা মেনকোজের ২ গ্রাম বা রিডােমিল গােল্ড ২ গ্রাম / প্রতি লিটার পানি মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে ।
মিষ্টিকুমড়ার পাতার দাগ রােগের লক্ষণঃ
> পাতার পানি ভেজা দাগের মতাে ছােট ছােট ক্ষত সৃষ্টি হয় । দাগগুলাে একত্রে বড় হয় এবং বাদামী রঙ ধারণ করে ।
> পরবর্তীতে আক্রান্ত পাতাগুলি শুকিয়ে যায়।
সমন্বিত ব্যবস্থাপনাঃ
> আক্রান্ত পাতা সংগ্রহ করে নষ্ট করতে হবে ।
> রােগমুক্ত গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করা ।
> রােগ দেখা দিলে কার্বোনডাজিম ( ব্যাভিষ্টিন ) ১ গ্রাম বা মেনকোজের ২.৫ গ্রাম ( ডাইথেন - এম -৪৫ ) বা রিডােমিল গােল্ড ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে ।
ফসল সংগ্রহঃ আমরা পাকা ফলগুলাে কাঁচা বা পাকা দুই অবস্থায়ই সংগ্রহ করা যায় । তবে ৪-৬ মাস সংগ্রহ করে রাখতে পারি।
ফলন : ফলের গড় ওজন ৪-৫ কেজি । হেক্টর প্রতি ফলন ১৮-২০ মে.টন।




0 Comments