বিটি বেগুনের ক্ষতিকর পােকামাকড় ও রােগ বালাইয়ের সমন্বিত ব্যবস্থাপনা

 আগের পর্বে আমরা বিটি বেগুনের জাত পরিচিতি ও আধুনিক উৎপাদন প্রযুক্তি সম্পর্কে জেনেছি। আজ আমরা বিটি বেগুনের ক্ষতিকর পােকামাকড় ও রােগ বালাইয়ের সমন্বিত ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জানবো। 

বিটি বেগুনের জাত পরিচিতি ও আধুনিক উৎপাদন প্রযুক্তি সম্পর্কে জানতে এখানে Click করুন।

 

ক্ষতিকর পােকামাকড় ও সমন্বিত ব্যবস্থাপনাঃ


বিটি বেগুনের ক্ষতিকর পােকামাকড় ও রােগ বালাইয়ের সমন্বিত ব্যবস্থাপনা


১। সাদা মাছিন্ন ক্ষতির ধরণঃ পূর্ণ বয়স্ক পােকা ও নিস্ফ ফ্লোয়েম ছিদ্র করে গাছ থেকে ক্রমাগত রস শােষণ করে । পাতা বাদামী বর্ণের হয় । ফলে পাতার খাদ্য তৈরি প্রক্রিয়া ব্যাহত হয় । পাতা অসম প্রকৃতির এবং ক্রমান্বয়ে শুকিয়ে যায় । অত্যধিক আক্রমণে গাছের বৃদ্ধি ও ফলন কমে যায় । 


সমম্বিত ব্যবস্থাপনাঃ 

> বীজতলায় চারা সুরু নেটের দ্বারা ঢেকে দিতে হবে । এর ফলে চারাগুলি সাদামাছির আক্রমণ থেকে মুক্ত থাকবে । 


> ফসলের অবশিষ্টাংশ নষ্ট না করে ফেলতে হবে এবং আগাছা পরিষ্কার করতে হবে । নিম বীজ ভিজানাে পানি ( প্রতি লিটার পানিতে ৫০ গ্রাম আধ ভাঙ্গা নিম বীজ ১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে ) প্রয়ােগ করতে হবে । 


আঠালাে হলুদ ফাঁদ ( Yellow sticky Trap ) ব্যবহার করতে হবে । 


> আক্রমণের শুরুতে বায়োনিম প্লাস ( Azadiractin ) @ ১ মিলি / লিটার পানিতে মিশিয়ে আক্রান্ত পাতায় স্প্রে করতে হবে । 


> আক্রমণের শুরুতে Polo 500 SC ( Difenthion ) @ ১ মিটার / লিটার পানিতে মিশিয়ে আক্রান্ত পাতায় স্প্রে করতে হবে অথবা আক্রমণের শুরুতে ইনটিপ্রিড ১০ এস সি ( Chlorfenapyl ) প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি মিশিয়ে পাতায় স্প্রে করতে হবে । 


২। থ্রিপস পােকার ক্ষতির ধরণঃ নিম্ফ ও পূর্ণবয়স্ক পােকা পাতা ছিদ্র করে রস শোষণ করে । ফলে পাতায় ক্ষতের সৃষ্টি হয় এবং পাতা কুঁকড়ে যায় । অতিরিক্ত আক্রমণে পাতার প্রাথমিক অবস্থায় এদের আক্রমণ হলে ফলন কমে যায় । অতিরিক্ত আক্রমণে পাতার নিচের অংশ বাদামী রঙ ধারণ করে , পরবর্তীতে পুড়ে মতাে দেখায় । 


সমন্বিত ব্যবস্থাপনাঃ 

> সঠিকভাবে সেচ প্রদান করতে হবে । সেচ বা জমি ভিজিয়ে দিলে মাটিতে বিদ্যমান প্রিপিউপা ও পিউপা মারা যায় । 


> মাঠে আক্রান্ত গাছ তুলে ফেলতে হবে এবং আগাছা দমন করতে হবে । 


> ফসলের ক্ষেতে সাদা আঠালাে ফাঁদ ব্যবহার করতে হবে ।


> আক্রমণের শুরুতে সাকসেস ২.৫ এস সি ( spinosad ) প্রতি লিটার পানিতে ১.২ মিলি মিশিয়ে পাতায় স্প্রে করতে হবে অথবা আক্রমণের শুরুতে ইনটিপ্রিড ১০ এস সি প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি মিশিয়ে পাতায় স্প্রে করতে হবে । 


৩। জাবপােকার ক্ষতির ধরণঃ পূর্ণ বয়স্ক পােকা ও নিস্ফ উভয়েই গাছের নতুন ডগা ও পাতা থেকে রস চুষে খায় । এদের আক্রমণে পাতা কুঁকড়ে যায় , গাছের বৃদ্ধি কমে যায় । 


সমন্বিত ব্যবস্থাপনাঃ 

> সংগ্রহের পর ফসলের অবশিষ্টাংশ নষ্ট করা । 

> আঠালো হলুদ ফাঁদ ( Yellow sticky Trap ) ব্যবহার করতে হবে । 


> বায়ােমিন প্লাস ১ মিলি / লিটার পানিতে মিশিয়ে আক্রান্ত পাতায় স্প্রে করতে হবে । 


> সুমিথিয়ন ৫০ ইসি ম্যালাথিয়ন ৫৭ ইসি বা ফাসটাক ২ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি অথবা এসাটাফ ৭৫ ডব্লিউপি প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম বা ২০০ এসএল প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি মিশিয়ে পাতায় স্প্রে করতে হবে । 


৪। কাটালে পােকার ক্ষতির ধরণঃ পূর্ণবয়স্ক পােকা ও কীড়া পাতার সবুজ অংশ খেয়ে ফেলে । ফলে গাছের পাতা খাদ্য তৈরি প্রক্রিয়া বাঁধাগ্রস্ত হয় । আক্রান্ত পাতা স্বচ্ছ জালের মত হয়ে যায়।


 ধীরে ধীরে শুকিয়ে গাছ থেকে ঝরে পড়ে । আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে অধিকাংশ পাতাই নষ্ট হয়ে যায় । আক্রান্ত গাছের বৃদ্ধি কমে যায় এবং ফলন কম হয় । অত্যধিক আক্রমণে চারা গাছ সম্পূর্ণভাবে মারা যেতে পারে।


ব্যবস্থাপনাঃ

> আক্রমণের প্রাথমিক অবস্থায় ডিমের গাদা , লার্ভা , পিউপা ও পূর্ণ বয়স্ক পােকা হাত দ্বারা ধ্বংস করতে হবে । 

> ক্ষেত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে । 


৫। লাল মাকড়ের ক্ষতির ধরণঃ 

> এরা কোষ ছিদ্র করে পাতা থেকে রস চুষে খায় । ফলে পাতার উপরের অংশে ফ্যাকাশে রঙ ধারণ করে এবং গাছের খাদ্য তৈরি প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয় । গাছের বৃদ্ধি ও ফুল ফল ধারণ বিঘ্নিত হয় এবং ফলন কমে যায় । 


> অতিরিক্ত আক্রমণে পাতার নিচে অংশ বাদামী রঙ ধারণ করে , পরবর্তীতে পুড়ে যাওয়ার মতাে দেখায় । 


সমম্বিত ব্যবস্থাপনাঃ 

> জমি , জমির আইল , সেচ নালা আগাছা মুক্ত রাখতে হবে । 

> আক্রান্ত ফসলে সেচ প্রয়ােগ করতে হবে । ধুলাবালি থাকলে এদের আক্রমণ বেড়ে যায় । ভারী বৃষ্টিপাতে মাইটের আক্রমণ কমে যায় । 

> মাকড় নাশক ( ভার্টিমেক ১.৮ ইসি অথবা Abom ১.৮ ইসি অথবা Ambush ১.৮ ইসি ) প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলি মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে । 


বেগুনের রােগবালাই ও ব্যবস্থাপনাঃ 


১। ডেম্পিং অফ রােগের লক্ষণঃ বীজতলায় বপনকৃত বীজ গঁজানাের পূর্বে এবং পরে কচি চারা রোগাক্রান্ত হতে পারে । অঙ্কুরােদগমরত বীজ সংক্রান্ত হলে তা থেকে চারা গঁজায় না । 


গঁজানাের পর রােগের আক্রমণ হলে চারার কান্ড মাটি সংলগ্ন স্থানে পচে গিয়ে নেতিয়ে পড়ে । একটু বড় হওয়ার পর আক্রান্ত হলে চারা সাধারণত মরে না , কিন্তু এদের শেকড় দুর্বল হয়ে যায় । 


চারা এভাবে নষ্ট হওয়াকে বলে ডেম্পিং অফ । বিভিন্ন ছত্রাক এর জন্য দায়ী । বীজতলায় মাটি সব সময় ভেজা থাকলে এবং মাটিতে বাতাস চলাচলের ব্যাঘাত হলে এ রোগ বেশি হয়। 


এ জন্য বীজতলায় মাটি সুনিষ্কাশিত রাখা রােগ দমনের প্রধান উপায় । 


ব্যবস্থাপনাঃ 

> প্রতিষেধক হিসেবে মাটিতে ক্যাপটান , কপার অক্সিক্লোরাইড বা ডায়থেন এম -৪৫ ১-২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে বীজতলার মাটি ভাল করে ভিজিয়ে কয়েকদিনের পর বীজ বপন করতে হবে ।


> বপনের পূর্বে প্রভােক্স , ভিটাভেক্স বা রিডােমিল গােল্ড ( ২.৫ গ্রাম / কেজি বীজ ) দ্বারা বীজ শােধন করতে হবে । 


২। কান্ড ও ফলপঁচা ( ফমােপসিস ) রােগের লক্ষণঃ

ফলে হালকা ছােট দাগ দেখা যায় , যা পরবর্তীতে গােলাকার বাদামী রঙের ক্ষতের সৃষ্টি করে ফল পচিয়ে ফেলে । মাটির সংযােগস্থলে কান্ড সরু হয় । আক্রান্ত অংশের ছাল শুকিয়ে ভিতরের কাঠ বেরিয়ে পড়ে । বাতাসে গাছ ভেঙ্গে যেতে পারে । 


সমন্বিত ব্যবস্থাপনাঃ 

> সুস্থ - রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার করা । 

> ফসল সংগ্রহের পর মুড়ি গাছ না রেখে সমস্ত গাছ , ডালপালা , পাতা ইত্যাদি একত্রে পুড়িয়ে ফেলা । 

> রােগ কান্ডে দেখা দিলে গাছের গােড়াসহ মাটি প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম ব্যভিস্টিন বা নােইন মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে । 


৩। ঢলেপড়া রােগের লক্ষণঃ ব্যাক্টেরিয়াজনিত এ রােগের আক্রমণে গাছ ঢলে পড়ে ও দ্রুত মারা যায় এবং ফলন কম হয় । 

ব্যবস্থাপনাঃ 

> আক্রান্ত গাছ দেখলেই প্রাথমিকভাবে তা তুলে ধ্বংস করা। 

> রােগ প্রতিরােধী জাতের চাষ করা । 

> আক্রান্ত জমিতে শস্য পর্যায় ( Crop rotation ) অনুসরণ করতে হবে । 

> পরিমাণমত সেচ দিতে হবে । 


৪। গুচ্ছপাতা রােগের লক্ষণঃ গাছের শেষ বয়সে রােগটি বেশি দেখা যায় । আক্রান্ত গাছের আগায় বা উগায় অসংখ্য ছােট ছােট পাতা হয় । পাতার হপার পােকার মাধ্যমে এই রােগ দ্রুত ছড়ায় । আক্রান্ত গাছে ফুল ও ফল ধরে না বলে ফলন কম হয় ।



ব্যবস্থাপনাঃ 

> আক্রান্ত গাছ দেখলেই প্রাথমিকভাবে তা তুলে ধ্বংস করা । 

> ক্ষেতের আগাছা পরিষ্কার করা । 

> ক্ষেতে পাতার হপার পােকার উপস্থিতি দেখা দিলে ডেল্টামেথ্রিন ( ডেসিস ) ১ মিলি / লিটার পানি ফেনভেলারেট ( ফেনসিড , ভেলাকেন , সুমিসাইডিন ) ১ - মিলি / লিটার পানি । 


ফসল সংগ্রহ ও বাজারজাতকরণঃ

> চারা লাগানাের ২-৩ মাস পরই বেগুন সগ্রহের উপযােগী হয় । বেগুনের ফলন এমন পর্যায় সংগ্রহ করতে হয় যখন ফল পূর্ণ আকার প্রাপ্ত হয় অথচ বীজ শক্ত হয় না । 

প্রতি সপ্তাহে গাছ থেকে ধারালাে ছুরির সাহায্যে বেগুন কাটা ভাল । বাজারে বিটি বেগুন বিক্রি করতে হলে বর্তমানে বায়ােসেফটি নিয়ম অনুযায়ী লেবেগিং ( ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পােকা দমনের জন্য বিটি বেগুনে কোন কীটনাশক ব্যবহার করা হয়নি । 


" No insecticide use for Bt brinjal against BSFB ” করে বিক্রি করতে হবে । 


ফলনঃ বিঘা প্রতি ৫-১০ টন ।


Reactions

Post a Comment

0 Comments