গ্রীষ্মকালীন টমেটোর উন্নত জাত পরিচিতি ও আধুনিক উৎপাদন প্রযুক্তি ।

 গ্রীষ্মকালীন টমেটোর জাত পরিচিতিঃ


গ্রীষ্মকালীন টমেটোর উন্নত জাত পরিচিতি ও আধুনিক উৎপাদন প্রযুক্তি ।


হরমােন সহযােগে চাষযােগ্য জাতসমূহঃ- বারি টমেটো -৪ , বারি টমেটো -৫ , বারি টমেটো -৬ , হাইব্রিড টমেটো মিন্টু সুপার ও সামার কিং টমেটো । 


হরমােন ছাড়া চাষযােগ্য জাতসমূহঃ- বারি টমেটো -১০ , বারি টমেটো -১৩ , বারি হাইব্রিড টমেটো -৩ ও বারি হাইব্রিড টমেটো- ৪ , 


বারি টমেটো -৪ঃ 

> ফলের রং লাল এবং গােলাকার , ওজন ৩৫-৪০ গ্রাম। 

> প্রতিটি গাছে ২০-২৫টি ফল ধরে । গাছ প্রতি ফলন প্রায় ১.৫ কেজি । 

> চারা লাগানাের ৬০-৬৫ দিনের মধ্যে ফল পাকতে শুরু করে । 

> এ জাতটি উচ্চ তাপসহনশীল এবং সারা বছরই এর চাষ করা যায় । 

> জীবনকাল ৯০-৯৫ দিন । 

> হেক্টর প্রতি ফলন ২০-২২ টন । 


বারি টমেটো -১১ ( ঝুমকা ):- 

> গাছ লম্বাকৃতি ও কম ঝােপালে । 

> ফলের আকার ছােট , ওজন ৮-১০ গ্রাম । 

> প্রতি গুচ্ছে ১৫-২০ টি ফল আঙ্গুরের মতাে থােকায় থােকায় ধরে । 

> গাছ প্রতি ফল ১৮০-২০০ টি এবং ফলন প্রায় ১ কেজি । 

> গ্রীষ্ম মৌসুমে ২-৩ টন / বিঘা । 


বারি হাইব্রিড টমেটো -৩ঃ-

> এটি একটি উচ্চ তাপসহিষ্ণু গ্রীষ্মকালীন শংকর জাত ( হাইব্রিড ) । 

> ফল অনেকটা কুল বা বরই আকৃতির । 

> প্রতিটি গাছে গড়ে ৩৫ টি ফল ধরে । 

> প্রতিটি ফলের গড় ওজন ৩৫ গ্রাম । 

> গাছ প্রতি ফলন ১.২-১.৩ কেজি । 

> এ জাত ব্যাক্টেরিয়াজনিত ঢলেপড়া রােগ সহনশীল । 

> ফলন ৩০ টন / হেক্টর । 


বারি হাইব্রিড টমেটো- ৪ঃ-


> গ্রীষ্মকালীন এ শংকর ( হাইব্রিড ) জাতের ফল আকারে মাঝারি । 

> গােল আকর্ষণীয় লাল রঙের । 

> ফলের গড় ওজন ৫০ গ্রাম । গাছ প্রতি গড়ে ৩০ টি ফল ধরে । 

> এবং গাছ প্রতি ফলন প্রায় ১.৫ কেজি । 

> গ্রীষ্ম মৌসুমে ফল উৎপাদনের জন্য কৃত্রিম হরমােন প্রয়ােজন হয় না । 

> তবে হরমােন প্রয়ােগের মাধ্যমে ফল ধারণ প্রায় দ্বিগুণ । 

> করা যায় এবং ফলনও অনেক বৃদ্ধি পায় । 

ফলন ৪০ টন / হেক্টর । 


হাইব্রিড টমেটো মিন্টু সুপারঃ-

> রং টকটকে লাল । 

> আকারঃ চ্যাপ্টা ও মাংসল ।  

> ওজনঃ ১২০-১৪০ গ্রাম । 

> একরপ্রতি ফলনঃ ৪০-৫০ টন ।


সামার কিং টমেটোঃ-

> সারাবছর চাষ করা যায় । 

> গ্রীষ্মকালেও চাষের উপযােগী । 

> ফলের রং সবুজাভ ও ফলত্বক তুলনামূলকভাবে বেশি পুরু । এজন্য বেশি দিন সংরক্ষণ করা যায় । 

> সুস্বাদু ও পুষ্টি গুনে সমৃদ্ধ । 

> একবার চাষ করলে একধারে ৫ বছর ফলন পাওয়া সম্ভব । 

> আগাম ধ্বসা রােগ প্রতিরােধী জাত । 

> প্রতি বিঘায় ( ৩৩ শতাংশ ) ৮০ মণ ফলন পাওয়া যায়। 

এছাড়াও বারি টমেটো -৩ , বারি টমেটো -৮ গ্রীষ্মকালীন টমেটোর উন্নত জাত । 


গ্রীষ্মকালীন টমেটোর আধুনিক উৎপাদন প্রযুক্তিঃ


গ্রীষ্মকালীন টমেটোর উন্নত জাত পরিচিতি ও আধুনিক উৎপাদন প্রযুক্তি ।


জলবায়ু ও মাটিঃ-

রাতের তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রি সে. এর নিচে থাকলে ফুল ও ফল ধারণের জন্য বেশি উপযােগী । 

গড় তাপমাত্রা ২০-২৫ ° সে . হলে টমেটোর ফলন ভালো হয় । 

আলাে বাতাসযুক্ত উর্বর দো - আঁশ মাটি টমেটো চাষের জন্য সবচেয়ে ভালো । 

তবে উপযুক্ত পরিচর্যায় বেলে দো - আঁশ থেকে এটেল দো - আঁশ সব মাটিতেই টমেটো ভালো জন্মে । 

বন্যার সময় পলি জমে এমন জমিতে এ ফলন সবচেয়ে বেশি । মাটির অম্লতা ৬-৭ হলে ভালো হয় । মাটির অম্লতা বেশি হলে চুন প্রয়ােগ করা উচিত । 


বীজ বপনের সময় : মে - জুন মাস। 


চারা উৎপাদন : -

গ্রীষ্মকালে টমেটো চাষের জন্য বীজতলায় চারা উৎপাদন করার জন্য নিম্নোক্ত বিষয়গুলি বিবেচনা করা উচিত । 


বীজতলার স্থান নির্বাচন :- 

বীজতলার জমি অপেক্ষাকৃত উঁচু হওয়া বাঞ্ছনীয় , যাতে বৃষ্টি বা বন্যার পানি দ্রুত নিষ্কাশন করা যায় । ছায়াবিহীন পরিষ্কার এবং বাতাস চলাচলের উপযােগী স্থানে বীজতলা করা প্রয়ােজন । 


পানির উৎসের কাছাকাছি এবং বাড়ি , খামার বা অফিসের কাছাকাছি হওয়া দরকার । বীজতলার মাটি বেলে দোআঁশ বা দোআঁশ এবং উর্বর হওয়া উচিত । 


বেলে মাটি বেশি হলে কাদামাটি , গােবর বা কম্পােষ্ট মিশিয়ে অথবা অতিরিক্ত কাঁদামাটি হলে বালু , কম্পােষ্ট বা গোবর সার মিশিয়ে মাটির পানি ধারণ ও নিষ্কাশনের উপযােগী করে বীজতলার মাটি উন্নত করা যায় । 


বাণিজ্যিকভাবে চারা উৎপাদন করতে হলে বীজতলা যতদূরসম্ভব ক্রেতাদের কাছাকাছি এবং ভালাে যােগাযােগ সম্পন্ন স্থানে স্থাপন করা উচিত । 


বীজতলার মাটিশােধন :-

বীজ বপনের পূর্বে বীজতলার মাটিশােধন করা উচিৎ । এতে অনেক মাটিবাহিত রােগ , পােকামাকড় আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে দমন করা যায় । যেমন- 

> সৌরতাপ ব্যবহার করে । 

> জলীয় বাষ্প ব্যবহার করে । 

> রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে । 

> কাঠের গুড়া পুড়িয়ে । 

> পােল্ট্রি রিফিউজ ব্যবহার করে । 


উল্লিখিত বিভিন্ন পদ্ধতির মধ্যে সবচাইতে সহজ ও কার্যকরী পদ্ধতি হলাে সৌরতাপ ব্যবহার করে বীজতলার মাটি শোধন করা। এক্ষেত্রে - 


> বীজ বপনের ১২-১৫ দিন পূর্বে বীজতলার মাটি যথাযথভাবে তৈরি করে ভালােভাবে পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিতে হবে । 


> পরে স্বাচ্ছ অথবা রঙিন পলিথিন দিয়ে বায়ুনিরােধ করে ঢেকে রাখতে হবে । এতে সারা দিনের সূর্যালােকে পলিথিনের ভিতরে বীজতলার মাটির তাপমাত্রা যথেষ্ট বৃদ্ধি পাবে ও অনেকাংশে মাটিবাহিত রােগজীবাণু দমন করবে । 


> এছাড়াও অনেক ক্ষতিকারক পােকামাকড় ও আগাছা দমন হয় । 


বীজতলায় রাসায়নিক দ্রব্য ফরমালডিহাইড পানিতে মিশিয়ে ( ৫০ : ১ ) ব্যবহার করেও মাটি শােধন করা যায় । 


বীজতলা তৈরিঃ 

> একক বীজতলা বা হাপাের সাধারণত এক মিটার চওড়া ও তিন মিটার লম্বা হবে । জমির অবস্থাভেদে দৈর্ঘ্য বাড়ানাে কমানাে যেতে পারে । 

> পাশাপাশি দুটি বীজতলার কমপক্ষে ৬০ সেমি. ফাঁকা রাখতে হবে । 

> বীজ বপনের কয়েকদিন আগে বীজতলার মাটি ২০-২৫ সেমি. গভীর করে ঝুরঝুরা ও ঢেলামুক্ত করতে হবে । বীজতলার সাধারণত ১০-১৫ সেমি . উচু করে তৈরি করতে হবে । 

> মাটি , বালি ও পচা গােবর সার বা কম্পােষ্ট মিশিয়ে বীজতলার মাটি তৈরি করতে হয় । মাটি উর্বর হলে রাসায়নিক সার না দেয়াই ভালাে । উর্বরতা কম হলে প্রতি হাপােরে ১০০ গ্রাম টিএসপি বীজ বপনের অন্তত এক সপ্তাহ আগে মিশিয়ে হবে । 

> যারা বাণিজ্যিকভাবে চারা উৎপাদন করেন তাদের জন্য ইট - সিমেন্ট দিয়ে স্থায়ী বীজতলা তৈরি করাই শ্রেয় । 


বীজশােধনঃ- 

বীজতলায় বীজ বপণের পূর্বে টমেটো বীজ কয়েকটি পদ্ধতিতে শােধন করা যায়ঃ- 

> প্রতি কেজি বীজ ২.৫ গ্রাম ভিটাভেক্স -২০০ বা ক্যাপটান ব্যবহার করে ভালােভাবে ঝাঁকিয়ে বীজ শােধন করা যায় । 

> বীজ শােধনের ফলে বিভিন্ন সবজির এ্যানথ্রাকনােজ , লিফস্পট , ব্লাইট ইত্যাদি রােগ ও বপন পরবর্তী সংক্রমণ রােধ সম্ভব হয় । 


বীজ পরীক্ষাকরণঃ- 

ভালাে ও বিশুদ্ধ টমেটো বীজের অভাবে নির্দিষ্ট জাতের গুণাগুণ সম্পন্ন টমেটো উচ্চফলন পাওয়া যায় না । বীজের উদ্ধৃষ্টতা নির্ভর করে তার অঙ্কুরােদগম ক্ষমতার উপর । 


> অংকুরােদগম ক্ষমতা দেখার জন্য পেট্রিডিস বা ছােট থালা নিয়ে তার উপর ঐ মাপের চোষকাগজ পানি দিয়ে ভিজিয়ে ৫০-১০০ টি বীজ কয়েকদিন রেখে অংকুরােদগমের শতকরা হার বের করে নিতে হবে । 

> অংকুরােদগমের হার বের করার মাধ্যমে মূল্যবান বীজের সঠিক পরিমাণ , চারার সংখ্যা ইত্যাদি নির্ধারণ করা সহজ হয় । 


বীজ বপনঃ- 

> বীজতলায় সারি করে বা ছিটিয়ে বীজ বপন করা যায় , তবে সারিতে বীজবপন করা উত্তম ।

> সারিতে বীজবপনের জন্য প্রথমে নির্দিষ্ট দূরত্বে ( ৪ সেমি . ) কাঠি দিয়ে ক্ষুদ্র নালা তৈরি করে তাতে বীজ ফেলে মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হয় । 


> ছােট বীজের বেলায় বীজের দ্বিগুন পরিমাণ শুকনাে ও পরিষ্কার বালু বা মিহি মাটি বীজের সাথে ভালােভাবে মিশিয়ে মাটিতে বীজবপন করতে হয় । 

> শুকনাে মাটিতে বীজবপন করে সেচ দেয়া উচিত নয় , এতে মাটিতে চটা বেঁধে চারা গঁজাতে ও বাতাস চলাচলে অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারে । তাই সেচ দেয়া মাটির “ জো " অবস্থা এলে বীজবপন করতে হয় । 


বীজতলার আচ্ছাদনঃ 

> আবহাওয়া এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে বীজতলার উপরে আচ্ছাদনের ব্যবস্থা করতে হবে যেন বৃষ্টির পানি ও অতিরিক্ত সূর্যতাপ থেকে বীজতলাকে রক্ষা করা যায় । 

> আচ্ছাদন বিভিন্নভাবে করা যায় । তবে কম খরচে বাঁশের ফালি করে বীজতলায় প্রস্থ বরাবর ৫০ সেমি. পরপর পুতে নৌকার ছৈ এর আকার করে বৃষ্টির সময় পলিথিন দিয়ে এবং প্রখর রােদে চাটাই দিয়ে বীজতলার চারা রক্ষা করা যায় । 

> প্রাথমিক অবস্থায় চারাকে পােকামাকড়ের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য মশারি দিয়ে ঢেকে রাখা যেতে পারে । 


সারের মাত্রা ও প্রয়ােগ পদ্ধতিঃ- 

গোবর : ১০ টনের অর্ধেক শেষ চাষের সময় এবং বাকী অর্ধেক চারা রােপণের সময় গর্তে দিতে হবে । 

ইউরিয়া : ৫৫০ কেজি এর ২০০ কেজি চারা রােপণের আগে গর্তে দিতে হবে এবং বাকী সার চারা রােপণের যথাক্রমে ৩ সপ্তাহ ও ৫ সপ্তাহ পর ১৭৫ কেজি হারে উপরিপ্রয়ােগ করতে হবে । 

টিএসপি : ৪৫০ কেজি চারা রােপণের সময় গর্তে দিতে হবে । 

এমপি : ২৫০ কেজি চারা রােপণের সময় গর্তে দিতে হবে । 

জিপসাম : ১৫০ কেজি শেষ চাষের সময় দিতে হবে । 

বােরণ : ১.৩ কেজি শেষ চাষের সময় দিতে হবে । 


দ্বিতীয় বীজতলায় চারা স্থানান্তরকরণ : 

> জমিতে চারা লাগানাের পূর্বে মূল বীজতলা থেকে তুলে দ্বিতীয় বীজতলায় টমেটোর চারা স্থানান্তকরণ করা হয় । 

> চারা উঠানাের আগে বীজতলায় পানি দিয়ে এরপর সূচালাে কাঠি দিয়ে শিকড়সহ চারা উঠাতে হয় । উঠানো চারা সাথে সাথে দ্বিতীয় বীজতলায় লাগাতে হয়। 

> বাঁশের সূচালাে কাঠি বা কাঠের তৈরি ফ্রেম দিয়ে সমান দূরত্বে সরু গর্ত করে চারাগাছ লাগাতে হয় । 

> লাগানাের পর হালকা পানি দিতে হবে এবং বৃষ্টির পানি ও প্রখর রােদ থেকে রক্ষার জন্য পলিথিন বা চাটাই দিয়ে ঢেকে দিতে হবে ।


গ্রীষ্মকালীন টমেটোর ক্ষতিকর পোকামাকড় ও সমন্বিত ব্যবস্থাপনা সমূহ জানতে এখানে Click করুন

Reactions

Post a Comment

0 Comments