গ্রীষ্মকালীন টমেটোর ক্ষতিকর পোকামাকড় ও সমন্বিত ব্যবস্থাপনা সমূহ


টমেটোর ক্ষতিকর পােকামাকড় ও ব্যবস্থাপনাঃ


গ্রীষ্মকালীন টমেটোর ক্ষতিকর পোকামাকড় ও সমন্বিত ব্যবস্থাপনা সমূহ


আমরা আগের পর্বে জেনেছি গ্রীষ্মকালীন টমেটোর উন্নত জাত পরিচিতি ও আধুনিক ভাবে কিভাবে অধিক পরিমান টমেটো উৎপাদন করা যায় সে সম্পর্ক। 

 আর আজকে আমরা জানবো গ্রীষ্মকালীন টমেটোর ক্ষতিকর পোকামাকড় ও তার সমন্বিত ব্যবস্থাপনা সম্পর্ক।  

তো গ্রীষ্মকালীন টমেটোর উন্নত জাত পরিচিতি ও আধুনিক উৎপাদন প্রযু্ক্তি সম্পর্কে জানতে এখানে Click করুন।

  

সাদা মাছির ক্ষতির ধরণ : 

> সাদামাছি পােকা পাতার রস চুষে খায় বলে পাতা কুঁকড়ে যায় । 

> এদের আক্রমণ পাতার মধ্যে অসংখ্য ছােট ছােট সাদা বা হলদে দাগ দেখা যায় । পরে অনেক দাগ একত্রে মিশে সবুজ শিরাসহ পাতা হলুদ হয়ে যায় । 

> সাদামাছি পােকার নিষ্ফ রস খাওয়ার সময় এক ধরনের আঠালাে মধুর রস নিঃসরণ করে । এই রস পাতায় আটকে গেলে তাতে সুটিমােল্ড নামক এক ধরণের কারাে রঙের ছত্রাক জন্মায়।  ফলে গাছের সালােকসংশেষণ ক্রিয়া বিঘ্নিত হয় । 


সমন্বিত ব্যবস্থাপনা : 

> এক কেজি আধা ভাঙ্গা নিম বীজ ১০ লিটার পানিতে ১২ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে উক্ত পানি পাতার নিচের দিকে স্প্রে করা । 

> নিমতেল ৫ মিলি + ৫ গ্রাম জেট পাউডার একত্রে প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে । 

> বীজতলা মশারির নেট দিয়ে ঢেকে রাখা । 

> নীল রঙের ফাদ ব্যবহার করা । তামাক পাতা ভিজানাে পানি সিঞ্চন করা । 

> বিকল্প পােষক যেমন : তামাক , তুলা , পাট , সীম , মিষ্টি আলু , বেগুন চাষ করা যাবে । 

> এডমায়ার ০.৫ মিলি / লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে । 


ফল ছিদ্রকারী পােকার ক্ষতির ধরণ : 

> এ পােকার আক্রমণের ফলে টমেটোর গায়ে পুরাতন কালচে বা নূতন ছিদ্র ও পােকার তৈরি সুড়ঙ্গ দেখা যাবে । 

> সুড়ঙ্গে কীড়াসহ পােকার বিষ্ঠা ও পচা অংশ নজরে পড়বে । 

> কীড়া ফলের ভিতর শরীরের সামনের কিছুটা অংশ ঢুকিয়ে খেতে থাকে এবং পেছনের অংশ ফলের বাইরে থাকে । 

> এদের কীড়া সম্পূর্ণ ফল নষ্ট না করে অংশ বিশেষ ক্ষতি করে । এভাবে একটি কীড়া অনেকগুলি ফল নষ্ট করে থাকে ।


সমম্বিত ব্যবস্থাপনা : 

> পাতসহ আক্রান্ত ফুল হাত বাছাই করে মেরে ফেলা । 

> এক কেজি আধা ভাঙ্গা নিম বীজ ১০ লিটার পানিতে ১২ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে উক্ত পানি স্প্রে করা । 

> হেলিকো - লিউর সেক্স ফেরােমন ফাঁদ ব্যবহার করা । 

> নিমতেল ৫ মিলি + ৫ গ্রাম জেট পাউডার একত্রে প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে । 

> আক্রমণের হার বেশী হলে সাইপারমেথ্রিন ৪০ ইসি জাতীয় কীটনাশক ( প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি , পরিমাণ ) স্প্রে করতে হবে । 


জাবপােকার ক্ষতির ধরণ : 

> প্রাপ্ত ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক জাব পােকা দলবদ্ধভাবে গাছের পাতার রস চুষে খেয়ে থাকে , ফলে পাতা বিকৃত হয়ে যায় , বৃদ্ধি ব্যহত হয় ও প্রায়শ : নিচের দিকে কোঁকড়ানাে দেখা যায় । 

> মেঘলা , কুয়াশাচ্ছন্ন এবং ঠান্ডা আবহাওয়ায় এদের বংশ বৃদ্ধি বেশি হয়।

> প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টি হলে এদের সংখ্যা কমে যায় । 


সমন্বিত ব্যবস্থাপনা : 

> প্রাথমিক অবস্থায় আক্রান্ত পাতা ও ডগার জাবপােকা হাত দিয়ে পিষে মারা যায় । 

> নিম বীজের দ্রবণ ( ১ কেজি অর্ধভাঙ্গা নিম বীজ ১০ লিটার পানিতে ১২ ঘন্টা ভিজিয়ে ) অথবা ১০ লিটার পানিতে ২ চা চামচ গুড়া সাবান মিশিয়ে স্প্রে করে আক্রমণ কমানাে যায় ।

> হলুদ টিনের ফাঁদ স্থাপন করতে হবে । 

> প্রাকৃতিক অণুজীব নির্যাস এবামেকটিন সমৃদ্ধ ইকোম্যাক ব্যবহার করুন । 

> ম্যালাথিয়ন ৫৭ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলি . অথবা পিরিমর প্রতিলিটার পানিতে ১ গ্রাম হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে । 


পাতা সুড়ঙ্গকারী পােকার ক্ষতির ধরণ : 

> এ পােকার ক্ষুদ্র কীড়া পাতা ছিদ্র করে পাতার দুই পর্দার মাঝের সবুজ অংশ আঁকাবাঁকা সুড়ঙ্গ করে খায় । 

> ফলে পাতার আক্রান্ত অংশটুকু স্বচ্ছ পর্দার মতো দেখায় এবং পাতা ফ্যাকাশে বর্ণের হয়ে যায় ।

> বয়স্ক পাতায় আক্রমণ হলে বাদামি ছােপ ছােপ দাগ দেখা যায় । আক্রমণ বেশি হলে পাতা শুকিয়ে ঝরে পড়ে এবং ফলন খুব কম হয় । 


সমন্বিত ব্যবস্থাপনা : 

> আক্রান্ত পাতা সংগ্রহ করে ধ্বংস করা । 

> আঠালো হলুদ ফাঁদ ব্যবহার করা । 

> নিমতেল ৫ মিলি . + ৫ মিলি , ট্রিকস্ প্রতিলিটার পানিতে মিশিয়ে পাতায় স্প্রে করলে এ পােকার আক্রমণ হ্রাস পায় । 

> বেল্ট ২ মিঃ লিঃ / লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে । 


টমেটোর রােগবালাই ও সমন্বিত ব্যবস্থাপনাঃ 


ঢলেপড়া রােগের লক্ষণ : 

> গাছের যে কোন বয়সে এ রােগ দেখা যায় । 

> ছত্রাকজনিত কারণে চারার গােড়ায় পানি ভেজা দাগ হয়ে পচে যায় অনেক সময় শিকড় পচেও চারা মারা যায় । 

> পুরো গাছটি দ্রুত মারা যায় ও ফলন কম হয় । 


সমন্বিত ব্যবস্থাপনা : 

> আক্রান্ত গাছ দেখলেই তা তুলে ধ্বংস করা । 

> রােগ প্রতিরােধী জাতের চাষ করা । 

> বনবেগুন যথা টরভাম ও সিসিম্ব্রিফিলিয়ামের সাথে জোড় কলম করা । 

> মুরগির বিষ্ঠা / সরিষার খৈল বীজ বপনের তিন সপ্তাহ আগে জমিতে মিশিয়ে দিতে হবে । 

> আক্রান্ত জায়গায় রিডােমিল গােল্ড ( ০.২ % ) অর্থাৎ প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম ভালভাবে মিশিয়ে জমি ভিজিয়ে দিতে হবে । 


নাবী ধ্বসা / মড়ক রােগ / লেট ব্লাইট রােগের লক্ষণ

> টমেটো গাছের পাতাতে কালাে কালাে দাগ দেখা যায় যা পানিতে ভিজা ভিজা মনে হবে ।

> আক্রান্ত পাতার নিচে সাদা রঙের ছাতা ( ছত্রাকজনিত ) পড়ে থাকতে দেখা যায় । আক্রান্ত পাতা কান্ডে তুলার মতাে ছত্রাক জালির আবরণ দেখা যায় ।

> আক্রান্ত জমি থেকে পােড়া পােড়া গন্ধ পাওয়া যায় । 

> শেষ অবস্থায় পাতা , কান্ড , শাখা সবই আক্রান্ত হয়ে গাছগুলাে দেখতে সম্পূর্ন পুড়ে যাওয়ার মতো মনে হবে । 


সমন্বিত ব্যবস্থাপনা : 

> আক্রান্ত ফসল সম্পূর্ণ পুড়িয়ে ধ্বংস করে ফেলতে হবে । 

> আকাশ মেঘাচ্ছন্ন অথবা ঘন কুয়াশা ও গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি ৩-৪ দিনের বেশি চলতে থাকলে দেরি না করে ছত্রাকনাশক যেমন- রিডােমিল গােল্ড বা ম্যানকোজেব । প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম ভালভাবে মিশিয়ে প্রথম বার স্প্রে করার ৩ দিন পর ২য় বার স্প্রে করতে হবে । 


আগাম ধ্বসা বা আর্লি ব্লাইট রােগের রোগের লক্ষণ : 

> বয়স্ক গাছের পাতায় প্রথমে বলয়ের মত গাঢ় বাদামি দাগ পড়ে । 

> ফল আক্রান্ত হলে পাকার আগেই তা ঝরে পড়ে । ফলে ও পাতার অনুরূপ কুঁচকানাে বাদামি থেকে কালাে রঙের বলয়াকৃতি দাগ সৃষ্টি হয় । 

> বাতাসের আর্দ্রতা কম ও তাপমাত্রা বেশি হলে এ রােগ হয় ।


সমন্বিত ব্যবস্থাপনা : 

> রােগমুক্ত গাছ বা উৎস থেকে সংগৃহীত বীজ ব্যবহার কর । 

> শস্য পর্যায় অবলম্বন করা । 

> প্রতি লিটার পানিতে ৫-১০ গ্রাম ট্রাইকো - ভি ভালভাবে গুলে পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করলে সাদা তলানী পড়বে । উপরের পানি সাবধানে নিয়ে পাতায় কেন্দ্র করতে হবে । 

> অনুমােদিত ছত্রাকনাশক যথা রােভরাল ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে ভালভাবে গুলিয়ে ১৫ দিন অন্তর অন্তর স্প্রে ধরতে হবে । 


হলুদ পাতা কুঁকড়ানাে রোগের আক্রমণের লক্ষণ : 

> পাতা কিনারা থেকে মধ্যশিরার দিকে গুটিয়ে যায় । 

> পাতা খসখসে হয়ে শিরাগুলাে স্বচ্ছ হলুদ হয়ে কুঁকড়িয়ে যায় । 

> পাতা পীতবর্ণ হয়ে কুঁকড়িয়ে যায় ।

> আক্রান্ত পাতার ডগায় ছােটো ছোটো পাতা গুচ্ছ আকার ধারণ করে । 


সমন্বিত ব্যবস্থাপনা : 

> টমেটোর জমি আগাছামুক্ত রাখতে হবে । আক্রান্ত গাছ উঠিয়ে মাটিতে পুঁতে বা পুড়িয়ে ফেলতে হবে । 

> রোগমুক্ত চারা লাগাতে হবে । 

> ক্ষুদ্র ছিদ্রযুক্ত ( প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে ৪০-৫০ টি ছিদ্র ) নাইলনের নেট দিয়ে বীজতলা ঢেকে চারা উৎপাদন করতে হবে । 

> প্রতি লিটার পানিতে ৫-১০ গ্রাম ট্রাইকো - ভি ভালভাবে গুলে পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করলে সাদা তলানী পড়বে । উপরের পানি সাবধানে ফসলের পাতায় প্রয়ােগ করতে হবে । 

> চারা লাগানাের এক সপ্তাহ পর থেকে ৭-১০ দিন পরপর এডমায়ার নামক কীটনাশক ২ মিলি / লিটার পানিতে প্রয়ােগ করে সাদা মাছি পােকা দমন করতে হবে । 


টমেটোর ফল ফেটে যাওয়া সমস্যা ও ক্ষতির প্রকৃতি : 

তাপমাত্রার দ্রুত পরিবর্তন , অতি পানি ঘাটতির পর হঠাৎ সেচ দেওয়া বা গাছের শরীর বৃত্তীয় কারণে কখনাে কখনাে টমেটো ফেটে যায় । এতে টমেটো খাওয়ার অযোগ্য হয়ে পড়ে । 


সমন্বিত ব্যবস্থাপনা : 

> আগাম বীজ বপন করা । 

> নিয়মিত জমির আর্দ্রতা পরীক্ষা করে সেচ দেওয়া ও খরার সময় হঠাৎ জমিতে সেচ প্রয়ােগ না করা । 

> সুষম সার ব্যবহার করা । 

> সঠিক দূরত্বে চারা রােপণ করা । 


ফলস সংগ্রহঃ জাত ভেদে চারা রােপণের ৬০-৯০ দিনের মধ্যে । 

ফলনঃ জাতভেদে ৫০-৯০ টন / হেক্টর ( ২০০-৩৫০ কেজি / শতাংশ ) ।


Reactions

Post a Comment

0 Comments