পাইলস নিরাময়ের ঘরোয়া উপায়
পায়খানা করতে গেলে ব্যথা করে সাথে রক্ত যায়। পায়খানার রাস্তায় গোটা গোটা কি যেন হয়েছে সমাধান কি?
আমি অনেক রোগী দেখেছি যারা দীর্ঘদিন ধরে এই রোগে ভোগার পরে আর না পেরে তবেই ডাক্তারের কাছে এসেছেন। কারণ এই রোগটা নিয়ে কথা বলতে আমরা অনেকেই লজ্জা পাই, ডাক্তারের কাছে যেতে চায় না।
তাই ক্রমশ রোগটা জটিল হতে থাকে।
গ্যাস অম্বলে ভুগছেন ? পেটের সমস্ত গ্যাস বের করুন ৩মিনিটের মধ্যেই ৪টি ঘরোয়া উপায়ে।
হঠাৎ ব্লাড প্রেশার ( blood pressure ) বা উচ্চ রক্তচাপ বেড়ে গেলে কি করবেন?
ঘুমের সমস্যার ( sleep disturbance ) ঘরোয়া সমাধান। অনিদ্রা দূর করার জন্য ১৩ টি টিপস। insomnia causes.
আমি আজকের এই লেখাটির মাধ্যমে রোগটির কারন ও সমাধান খুব সহজ ভাষায় বুঝিয়ে দিব।
এজন্য মন দিয়ে সম্পূর্ণ লেখাটি পড়তে থাকুন। আশা করি আপনার উপকারে আসবে।
কি কারনে কি হচ্ছে? সবকিছুই আপনি জানতে পারবেন।
প্রথমে বুঝিয়ে বলি পায়ু পথে কি?
পায়ু পথ বলতে বোঝায় শরীর থেকে যেখান দিয়ে পায়খানা বের হয়ে যায়। এই পায়ু পথের মুখ সাধারণত বন্ধ থাকে।
আমাদের যখন প্রয়োজন হয় আমরা চাপ দিয়ে সেই পায়ুপথের মুখ খুলে শরীর থেকে পায়খানা বা মল বের করে দিই।
পায়ু পথের মুখ বন্ধ করে রাখতে সেখানে বেশ কিছু জিনিস একসাথে কাজ করে। তার মধ্যে একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ নাম হল অ্যানালকুশন।
এগুলো তিন দিক থেকে চাপ দিয়ে পায়ু পথের মুখ বন্ধ রাখতে সাহায্য করে।
যদি কোনো কারণে তিন দিকের এই কুশন গুলো ফুলে যায় সেগুলো থেকে রক্তক্ষরণ হয় বা সেগুলো নিচের দিকে নেমে যায়।
পায়ুপথের চারপাশে গোটার মতো দেখা যায় তখন সেটাকে আমরা পাইলস বা অর্শ নামে চিনি। মেডিকেলের ভাষায় নাম হলো হেমারয়েডস।
পাইলস হলে আপনার শরীরে কেমন প্রভাব ফেলতে পারে?
১। পায়খানার সাথে রক্ত যেতে পারে উজ্জ্বল লাল রঙের রক্ত। সাধারনত টয়লেট পেপার ব্যবহার করার পরে দেখা যায় সেখানে রক্তের ফোটা লেগে আছে অথবা কমেডের বা প্যানের গায়ে দেখা যায় লাল রক্তের ছোপ।
উজ্জ্বল লাল রক্ত কেন বের হয়?
১। পায়খানা বের হওয়ার পথে একদম শেষ প্রান্তে রাস্তার মুখে কুশন গুলো থেকে রক্তক্ষরণ হয়েছে। সেই রক্ত এখনো তাজা জমাট বাঁধার সুযোগ পায়নি তাই উজ্জ্বল লাল দেখা যায়।
পক্ষান্তরে রক্তক্ষরণ যদি আরো আগেই হত, ধরেন পাকস্থলিতেই রক্তক্ষরণ হয়েছে তারপর সেই রক্ত নাড়িভুঁড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে জমাট বাঁধে, জমে পায়খানার সাথে মিশে যায় তখন পায়খানার রং হয় আলকাতরার মত কালো।
এমন হলে দ্রুত হাসপাতালে যেতে হবে কারণ পরীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন কি হয়েছে।
২। কুশনগুলো ফুলে পায়ু পথ দিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে। তখন নরম গোটার মতো মনে হয় সেগুলো সাধারনত মলত্যাগের পরে বের হয়ে আসে আর নিজে নিজেই ভেতরে ঢুকে যায় বা আঙ্গুল দিয়েও ভেতরে ঢোকাতে হতে পারে।
আবার কারো কারো ক্ষেত্রে পাইলস এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে আঙ্গুল দিয়েও আর ভেতরে ঢুকানো যায়না।
৩। অনেকে দুশ্চিন্তা করেন এ রোগে ব্যথা কেমন হয়। সাধারণত তীব্র ব্যথা হয় না তবে কখনো কখনো তীব্র ব্যথা হতে পারে।
যেমন যদি পায়ু পথের বাইরে যদি নরম গোটা থাকে আঙুল দিয়ে ভেতরে ঢোকানো না যায় আর সেগুলোর রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায় তখন তীব্র ব্যথা হয়।
সাধারণত তীব্র ব্যথা এক থেকে দুই দিনের জন্য হয় তীব্র ব্যথা হলে একজন ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন যত শিগ্রই সম্ভব।
যদি ডাক্তারের কাছে যাওয়ার সুযোগ না থাকে তাহলে কিভাবে ব্যথা কমাবেন সেটি নিয়ে একটু পরে বলছি।
ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খাওয়ার পাশাপাশি এই কাজগুলোও করতে পারবেন।
৪। পাইলস হলে এছাড়াও আপনার পায়ু পথে চুলকাতে পারে। পায়ু পথ দিয়ে পিচ্ছিল কিছু পদার্থ বের হতে পারে যেটা দেখতে স্লেসমার মতো।
মলত্যাগ করার পরেও মনে হতে পারে যে পেট পরিষ্কার হয়নি আবারও মলত্যাগ করতে হবে।
এবার ঔষধ আর ঘরোয়া চিকিৎসা নিয়ে কথা বলব।
পাইলসের চিকিৎসায় একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো কোষ্ঠ্যকাঠিন্য দূর করা। এর জন্য একটা ভালো ঔষধ হলো ইসুপগুলের ভূষি।
আমরা সবাই এ ঔষধ কম বেশি চিনি। তবে এর সঠিক ব্যবহার ও সাবধানতা অনেকের অজানা।
ইসুপগুলের ভূষি কিভাবে খাবেন কখন খাবেন কখন খাওয়া উচিত না সেটা অল্প করে বলে দিচ্ছি
প্যাকেটের গায়ে লেখা নির্দেশনা অনুযায়ী পরিমান মতো পানি নিয়ে তাতে ইসুপগুলের ভুষি ভালো করে গুলিয়ে নিবেন যাতে শরবতটি দেখতে পরিষ্কার বা হালকা ঘোলা দেখায়।
বানানোর পর রেখে দিবেন না সাথে সাথে খেয়ে ফেলবেন। অনেক রোগীর কাছ থেকে শুনেছি এটা গুলিয়ে তারা রেখে দেয় এটা কিন্তু সঠিক ব্যবহার নয়।
সাধারণত দিনে দুই বেলা খেতে হয়। খাবার খাওয়ার পরে খেলে সবচেয়ে ভালো।ইসুপগুলের ভূষি খেলে দিনে অন্তত ২ লিটার করে পানি পান করবেন।
অল্প কিছু মানুষের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে ইসুপগুলের ভুষি খেয়ে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি না খাওয়ার ফলে গলনালী ও অন্ত্রের মুখ আটকে যায়।
আপনি অবশ্যই এই ঝুঁকি নিতে চাইবেন না। কিছু কিছু সময়ে ইসুপগুলের ভুষি খাওয়া যাবে না।
সেটি কোন কোন সময় ?
১। রাতে ঘুমানোর ঠিক আগে খাবেন না। তাতে আপনার বৃহদন্ত্র অর্থাৎ শরীরের যেখানে মল তৈরি হয় সে জায়গার মুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এটাকে বলে অবচট্রাকশন।
এটা একটা ইমারজেন্সি। এমনটা হলে জরুরি ভাবে হাসপাতালে যেতে হয়। আপনার আগে যদি এমনটা হয়ে থাকে তাহলে আপনি ইসুপগুলের ভুষি খাবেন না।
২. যদি পেটে ব্যথা, বমি ভাব বা বমি হয়।
৩. আগে ইসুপগুলের ভুষি খাওয়ার পর আপনার শরীরে যদি বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়ে থাকে।
৪. যদি দীর্ঘদিন ধরে কষ্ঠ্যকাঠিন্যের ফলে পায়ুপথের মুখে পায়খানা আটকে গেছে এমন হয়।
৫. যদি আপনার পায়খানা বা মল ত্যাগের অভ্যাসে হঠাৎ পরিবর্তন হয় এবং সেটার দুই সপ্তাহের বেশি থাকে।
৬. আগে থেকেই পায়ুপথ দিয়ে রক্ত যায় এবং সেটার কারণ এখনো জানা যায়নি।
৭. যদি কোলোনিক এর্টনি বা বৃহদন্ত্রের মাংস পেশি দুর্বল বা ধীর গতির এমন রোগে ভোগে।
ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া নিজে নিজে একটানা অনেকদিন ইসুপগুলের ভুষি খাবেন না এটা কিন্তু একটা ওষুধ।
ডায়রিয়া সহ আরো কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। তিন দিন ব্যবহার করার পরে কোষ্ঠকাঠিন্যের কোনো উন্নতি না হলে ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন।
এবার আসছি ব্যথার ওষুধ প্রসঙ্গেঃ-
ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল খেতে পারেন আরও অনেক ধরনের ঔষধ আর মলম আছে। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সেগুলো ব্যবহার করতে পারেন। পাইলস হলে কিছু কিছু ব্যথানাশক ওষুধ খাওয়া যাবে না
সেগুলো কি কি? -
১/ ট্রামাডল : কারন এই ওষুধটার একটা কমন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে কোষ্ঠ্যকাঠিন্য। বাজারের প্যারাসিটমল এর সাথে ট্রামাডল মেশানো ব্যাথানাশক ঔষধ পাওয়া যায় এগুলো এড়িয়ে চলতে হবে।
২/ হাইরোপ্রফেন: যদি আপনার পাইলস থেকে রক্ত যায় কারণ এই ঔষধটা রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
বাসায় বসে বসে ওষুধের পাশাপাশি আর কিভাবে নিজের চিকিৎসা করতে পারেন, ব্যথা কমাতে পারেন তা নিয়ে ১০ টা উপায় এখন বলব।
১। ব্যাথার জায়গাটা কুসুম গরম পানিতে ভিজিয়ে রাখতে পারেন। ছোট বাচ্চাদের গোসল করায় এমন একটা বড় বলে কুসুম গরম পানি নিয়ে সেখানটাতে বসতে পারেন।
সদ্য যারা মা হয়েছেন তাদের পাইলসের সমস্যা থাকলে দেখা যায় বাচ্চা হওয়ার পরে প্রথম কয়েক দিন সমস্যা বেড়ে যায় তাদের কেও এই কুসুম গরম পানি ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হয়।
তারা দিনে তিনবার পর্যন্ত করতে পারেন আর মায়েরা কোথাও বসার সময় একটা বালিশ ব্যবহার করে সেটার উপর বসতে পারেন।
২। একটা প্যাকেটে কিছু বরফ নিয়ে সেটা তোয়ালে দিয়ে পেচিয়ে পায়ুপথের গোটা গুলোর উপর লাগাতে পারেন।
৩। বিছানায় শুয়ে পা উঁচু করে রাখতে পারেন তাহলে গোটা গুলোতে রক্ত চলাচল সহজ হবে পায়ের নিচে বালিশ দিতে পারেন। খাটের পায়ের নিচে কোন কিছু দিয়ে খাটের একপাশ উঁচু করে সেদিকে পা দিতে পারেন।
৪। পায়ু পথ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আর সুষ্ক রাখবেন। মলত্যাগ করার পর খুব জোর দিয়ে মুছতে যাবেন না। টয়লেট পেপার হালকা ভিজিয়ে তারপর সেটা দিয়ে মুছতে পারেন।
৫। মলত্যাগ করার সময় খুব জোরে চাপ দেওয়া যাবে না।
৬। অনেক লম্বা সময় ধরে মল ত্যাগ করবেন না। টয়লেটে বসে বসে মোবাইল চালানো বই পড়া বা অন্য কাজ করাতে মনোনিবেশ করবেন না মোটকথা প্রয়োজনের অতিরিক্ত সময় টয়লেটে বসে থাকবেন না।
৭। পায়খানার চাপ আসলে সেটা আটকে রাখবেন না। পায়খানা আটকে রাখলে দিন দিন সেটা থেকে পানি শুকিয়ে শক্ত হতে থাকে তাই চাপ আসলে দেরি না করে বাথরুমে চলে যাবেন।
৮। কোষ্ঠ্যকাঠিন্য এড়িয়ে চলতে খাদ্যের যথেষ্ট পরিমাণে ফাইবার বা আঁশ নিশ্চিত করবেন এবং প্রচুর পরিমাণে পানি পান করবেন। এই দুটো কাজ করলে সাধারণত কয়েক দিনের মধ্যে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়।
আর কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই পাইলসের লক্ষণগুলোর উপশম হয়। ৬ সপ্তাহ অর্থাৎ দেড় মাস ধরে যদি খাবারের যথেষ্ট পরিমাণে ফাইবার নিশ্চিত করা যায়, তাহলে ৯৫ শতাংশ পাইলসের রোগীর পায়খানার সাথে রক্ত যাওয়া কমে আসে।
৯। নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম করবেন। ভারী ব্যায়াম বা প্রতিদিন দৌড়াতে হবে এমন না। শরীরকে চলমান রাখতে হবে সেটা হাটা-চলা, হাল্কা স্ট্রিং, যোগ ব্যায়াম ইত্যাদির মাধ্যমে হতে পারে।
আপনি অল্প অল্প করে শুরু করতে পারেন দিনে ২০ মিনিট হাটেন। এক বেলা দিয়ে শুরু করেন তারপর দিনে দুই বেলা সকালে আর সন্ধ্যায়ে হাটা শুরু করেন সপ্তাহে তিন দিন এমন করে আস্তে আস্তে ৫দিনে আনেন।
গবেষণায় দেখা গেছে এতোটুকু হাটলেও সেটা কোষ্ঠ্যকাঠিন্য কমাতে কার্যকরী।
১০/ ওজন অতিরিক্ত হলে সেটা কমিয়ে ফেলুন।
কখন ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে?
১। যদি সাত দিন বাসায় চিকিৎসা করেও পালসের কোনো উন্নতি না দেখেন।
২। যদি বারবার পাইলস হতে থাকে।
৩। বয়স যদি ৫৫ এর বেশি হয় এবং প্রথমবারের মতো পাইলসের লক্ষণ দেখা দেয়।
কখন দ্রুত হাসপাতালে যাবেন?
১। যদি পাইলস থেকে পুঁজ বের হতে থাকে।
২। যদি গায়ে খুব জ্বর আসে কাপুনি হয় বা খুব অসুস্থ লাগে।
৩। যদি অনবরত রক্তক্ষরণ হতে থাকে।
৪। যদি অনেক বেশি রক্ত যায় কমডের পানি লাল হয়ে গেছে বা বড় বড় রক্তের চাকা যাচ্ছে।
৫। যদি খুব তীব্র ব্যথা হয়।
৬/ যদি পায়খানা আলকাতরার মত কালো হয়।
আজ এখানেই শেষ করছি। আশা করি এই লেখাটি পড়ে আপনারা কিছুটা হলেও উপকৃত হয়েছেন।
আমাদের সাথে শেষ পর্যন্ত থাকার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
1 Comments
পায়খানা করার পরে একটা আঙ্গুল দিয়ে মল দ্বার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ভালো করে পরিষ্কার করবেন । যারা এটা নিয়মিত করে তাদের সহজে অর্শ হয় না , অল্প থাকলে ভালো হয়ে যায় ।
ReplyDelete